কী করি, নাক ডাকি
নারী-পুরুষনির্বিশেষে প্রায় ৪৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরই নাক ডাকার সমস্যা আছে। মাঝবয়সী ও বয়স্ক পুরুষের এ সমস্যা বেশি। ঘুম যখন হালকা থেকে গভীরে প্রবেশ করে, তখন মুখের তালুর পেশি, জিব ও গলা শিথিল হয়ে শ্বাসনালিকে আংশিকভাবে ব্লক করে নাক ডাকার অবস্থা সৃষ্টি করে। নাক ডাকাকে আমরা বড় সমস্যা মনে করি না কিন্তু এরই অন্য রূপ হলো অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা।
নাক ডাকার প্রবণতা
যাঁদের মুখ, সাইনাসের অকৃতিগত সমস্যা আছে, নাকের হাড় বাঁকা, সাইনাসে প্রদাহ, অ্যালকোহল সেবন, অ্যালার্জি, ঠান্ডা লাগার প্রবণতা, অতিরিক্ত ওজন আছে, তাঁরা ঝুঁকিতে আছেন। শিশুদের ক্ষেত্রে এডেনয়েড গ্রন্থি বড় হয়ে গেলে, ঘন ঘন সংক্রমণের কারণে টনসিল বড় হয়ে গেলে নাক ডাকে বেশি। অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার পারিবারিক ইতিহাস থাকলেও এটা হতে পারে।
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া কী
এ ধরনের রোগী সাধারণত শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়েন এবং নাক ডাকতে শুরু করেন। কিন্তু একপর্যায়ে রোগীর দম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে আসে। দম নেওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকেন রোগী, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমতে থাকে। একপর্যায়ে রোগীর ঘুম ভেঙে যায়; আবার স্বাভাবিক শ্বাস নিতে শুরু করেন রোগী। যেহেতু শরীর ক্লান্ত থাকে, দ্রুত আবার তিনি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, পুনরায় শুরু হয় নাক ডাকার প্রক্রিয়া। সারা রাত ধরেই আবর্তিত হতে থাকে এ চক্র। অনেক সময় রোগী নিজেও বুঝতে পারে না যে এমন হচ্ছে।
নাক ডাকার পাশাপাশি অন্যান্য যে উপসর্গ থাকে, সেগুলো হলো মাথাব্যথা, সকালে মাথা ভার হয়ে থাকা, দিনের বেলা ঘুম ঘুম ভাব বা তন্দ্রাভাবজনিত সমস্যা, বুদ্ধিমত্তার অবনতি, মনোনিবেশের অক্ষমতা, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন, হতাশা বা রাগ, উচ্চ রক্তচাপ, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ঘন ঘন প্রস্রাব, আগ্রাসন বা শেখার সমস্যা। অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগীর মৃত্যুঝুঁকিও বেশি। যেমন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট, হার্ট ফেইলিওর, স্ট্রোক, অ্যারিথমিয়া এবং শিশুদের ক্ষেত্রে কট ডেথ ইত্যাদি। দিনের বেলায় ঘুম ঘুম ভাব থাকে বলে গাড়ি চালালে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
রোগনির্ণয়
নাকের এন্ডোস্কপি, গলার এক্স-রে, বুকের এক্স-রে, ইসিজি, রক্তের কিছু নিয়মিত সাধারণ পরীক্ষা দরকার হতে পারে। স্লিপ অ্যাপনিয়া শনাক্ত করতে ‘পলিসমনোগ্রাফি’ নামে পরীক্ষা করে দেখা হয়। রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে একটি বিশেষ ব্যবস্থায় শরীরের বিভিন্ন স্থানে একাধিক লিড (পরিমাপক) বসিয়ে ঘুমের ব্যবস্থা করানো হয়। এর দ্বারা ঘুমের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা, এ সময় রক্তে অক্সিজেন বহন করার ক্ষমতা, মস্তিষ্কের তরঙ্গ, রক্তের অক্সিজেনের মাত্রা, হৃৎকম্পন, শ্বাসের হার, ঘুমের পর্যায়, চোখ ও পায়ের নড়াচড়া পরিমাপ করা হয়।
করণীয়
ওজন বেশি থাকলে কমিয়ে ফেলুন। যাঁদের ওজন বেশি, তাঁদের গলায় অতিরিক্ত টিস্যু থাকতে পারে, যা নাক ডাকায় ভূমিকা রাখে।
পাশ ফিরে ঘুমান। চিত হয়ে শুলে জিব গলার পেছন দিকে পরে শ্বাসনালিকে সংকুচিত করে এবং বায়ুপ্রবাহকে আংশিকভাবে বাধা দেয়। এ জন্য পাশ ফিরে ঘুমানো ভালো।
ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে ত্যাগ করতে হবে।
ঘুমের ওষুধ পরিহার করতে হবে।
দিনে অতিরিক্ত পরিশ্রমও পরিহার করা উচিত।
ঘরের আর্দ্রতা বজায় রাখুন। ঘরের বাতাস খুব শুষ্ক হয়ে গেলে, নাসিকা পর্দা শুকিয়ে যায়। তখন গলার পেশিতে কম্পন বেশি হয়। নাক ডাকে।
প্রাণায়াম অভ্যাস করুন। এতে শ্বাসক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়, ভালো হয় রক্তসঞ্চালনও। ঘুম ভালো হয়। খুব হালকা কিছু ব্যায়াম করুন, যা আপনার গলা ও মুখের পেশিকে শক্তিশালী করবে। ঘুমানোর সময় মাথার বালিশ একটু উঁচুতে রাখুন।
মসলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার খেলে পাকস্থলীতে বেশি মাত্রায় অ্যাসিডের প্রতিক্রিয়া শুরু হতে পারে।
চিকিৎসা
শিশুদের প্রধান কারণ হলো টনসিল ও এডেনয়েড গ্রন্থির প্রদাহ বা বড় হয়ে যাওয়া। এগুলোর কারণেই যদি এটি ঘটে থাকে, তাহলে অপারেশন করে অপসারণ করাই বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা।
নাকের সমস্যা থাকলে চিকিৎসা করতে হবে। নাকের অ্যালার্জি ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
নাকের হাড় বাঁকা থাকলে শল্যচিকিৎসা দ্বারা অস্ত্রোপচার করাতে হবে।
নাকে সিপিএপি (কন্টিউনাস পজিটিভ এয়ারওয়ে প্রেশার) মেশিন ব্যবহার করা যায়। প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর সময় মেশিনটি ব্যবহার করতে হয়। প্রথম দর্শনে দৃষ্টিকটু ও অস্বাভাবিক মনে হলেও এটি ব্যবহার শুরু করলে রোগীরা সুফল পেতে শুরু করেন।
অনুনাসিক স্ট্রিপ বা একটি বহিরাগত অনুনাসিক প্রসারকও ব্যবহার করা যায়।
*ডা. নওসাবাহ্ নূর: মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, পপুলার মেডিকেল কলেজ, ঢাকা

