চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার চাক্তাইয়ে বাণিজ্য দিয়ে ব্যবসায় হাতেখড়ি। তবে বাণিজ্যে বেশি দিন মন বসেনি তাঁদের। যে ভোজ্যতেল বেচাকেনা ও আমদানি করতেন তারই কারখানা দিয়ে শিল্পে পা রাখেন। প্রথম কারখানার সাফল্য পেয়ে শিল্পকারখানা গড়ার নেশা পেয়ে বসে তাঁদের। বাংলাদেশে শিল্পায়ন শুরুর প্রথম ধাপে এই দুই সহোদরের হাত ধরে অনেক নতুন শিল্পের গোড়াপত্তন হয়েছে এ দেশে।
যে দুই ভাইয়ের হাত ধরে এ দেশে অনেক প্রথম কারখানার যাত্রা শুরু হয়েছে, তাঁরা হলেন মোহাম্মদ আবু তৈয়ব ও মোহাম্মদ আবুল কালাম। দুই ভাইয়ের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি হয় টি কে (তৈয়ব-কালাম) গ্রুপ। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত টি কে গ্রুপ এ বছর ৫০ বছরে পা দিয়েছে।
অনেক প্রথম কারখানার পথ দেখানো টি কে গ্রুপের এখন উৎপাদনমুখী কারখানার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৩ বা তার অধিক। এসব কারখানায় ৪০০টির বেশি ইউনিটে দিন-রাত চলছে পণ্য উৎপাদন। গ্রুপটিতে প্রত্যক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের। গ্রুপটির বার্ষিক টার্নওভার ১৮ হাজার কোটি টাকা। সহযোগী প্রতিষ্ঠানের হিসাব ধরা হলে টার্নওভারের পরিমাণ আরও বাড়বে। গ্রুপটি প্রতিবছর সরকারকে বিপুল পরিমাণ রাজস্বও দিচ্ছে।
শুরুর কথা:-
মোহাম্মদ আবু তৈয়ব ও মোহাম্মদ আবুল কালামের বাবা মীর আহমেদ সওদাগর একসময় মিয়ানমারের রেঙ্গুনে (বর্তমানে ইয়াঙ্গুন) ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। ১৯৬২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর অন্যদের মতো তাঁকেও সব ছেড়ে ফিরে আসতে হয়। সেখান থেকে চট্টগ্রামের চাক্তাই ফিরে দোকান খোলেন। এরপর ১৯৭২ সালে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ আবুল কালামকে এক হাজার কেজি ধান বিক্রির টাকা দেন ব্যবসার জন্য। ধান বিক্রির ১ হাজার ৮০০ টাকা হাতে নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন আবুল কালাম। ধীরে ধীরে খাদ্যশস্যের সঙ্গে বাণিজ্যের তালিকায় যুক্ত হয় ভোজ্যতেল ও মসলা। সঙ্গে ছিলেন বড় ভাই মোহাম্মদ আবু তৈয়ব।
প্রায় এক দশক ধরে ভোজ্যতেল আর মসলা বাণিজ্যে বেশ লাভ হয়। সে সময় দেশীয় শর্ষের তেলের পাশাপাশি সয়াবিন তেল জনপ্রিয়তা বাড়ছিল। আমদানিও শুরু হয় পাম তেলের। নিজেরাও তেল আমদানি শুরু করেছিলেন। এসব তেল আমদানি হতো ড্রামে করে পরিশোধিত আকারে। যদি অপরিশোধিত তেল এনে পরিশোধন করে বাজারজাত করা যায়, তাহলে মূল্য সংযোজন হবে—এমন চিন্তা ছিল দুই ভাইয়ের।
সেই চিন্তা থেকেই ১৯৮৩ সালে সয়াবিন পরিশোধনের কারখানা গড়ে তোলার লাইসেন্স নেন। কয়েক বছরের মধ্যে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে ১৫০ জন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু হয় টি কে অয়েল রিফাইনারির। বেসরকারি খাতে এ দেশের উদ্যোক্তাদের হাতে গড়ে ওঠা বড় আকারের প্রথম কারখানা ছিল এটি। সে সময় চট্টগ্রামের নাছিরাবাদে সরকারি খাতে ছোট আকারের বালাগামওয়ালা ভেজিটেবল প্রডাক্টস কারখানা ছিল। টি কের কারখানা চালুর সময়ে সেটি ছিল বন্ধ।
অনেক প্রথম কারখানার সূচনা:-
শুধু ভোজ্যতেল পরিশোধনের কারখানাই নয়, দুই উদ্যোক্তার টি কে গ্রুপের হাতে দেশে অনেক প্রথম কারখানা গড়ে উঠেছে। এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারের কথাই ধরা যাক। তিন দশক আগেও দেশে এলপিজির ব্যবহার ছিল খুবই সীমিত। ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে সরবরাহ হতো এলপি গ্যাস। ১৯৯১ সালে এলপিজি রাখার সিলিন্ডার উৎপাদনের কারখানা নির্মাণ শুরু করেন তারা। এখন প্রতিদিন ৪০০টি সিলিন্ডার উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে কারখানাটির। এলপিজি খাতে নতুন নতুন বিনিয়োগ করছে এখন গ্রুপটি।
তিন দশক আগে ভোজ্যতেল সরবরাহ হতো বড় বড় ইস্পাতের পাতের তৈরি ড্রামে। জ্বালানি পণ্য লুব্রিকেন্টও এসব ড্রামে সরবরাহ হতো। এই ড্রাম তৈরির কারখানাও গড়ে তোলেন দুই উদ্যোক্তা। এটি ছিল বাংলাদেশে প্রথম ড্রাম কারখানা। সিমেন্ট ও খাদ্যশস্য রাখার পিপি ব্যাগের কারখানা চালু হয়েছে এই গ্রুপের হাত ধরে।
বাঙালি উদ্যোক্তার হাতে গড়ে ওঠা প্রথম পার্টিকেল বোর্ডের ইতিহাসও লেখা দুই ভাইয়ের হাতে। ১৯৮০-এর দশকে কাঠের বিকল্প পরিবেশবান্ধব পার্টিকেল বোর্ড খুব জনপ্রিয় ছিল না। তবে পার্টিকেল বোর্ড সামনে বাজার দখল করবে, এমন চিন্তা থেকে গ্রুপের উদ্যোক্তারা কালুরঘাটে গড়ে তোলেন টি কে পার্টিকেল বোর্ড মিলস। ওই সময় অবাঙালি উদ্যোক্তার হাতে গড়ে ওঠা একটি কারখানা ছিল পার্টিকেল বোর্ডের। টি কে কারখানা করার পর থেকে এখন পর্যন্ত পার্টিকেল বোর্ডে নেতৃত্ব দিচ্ছে টি কের সুপার বোর্ড। দেশে মোট পার্টিকেল বোর্ডের এক-চতুর্থাংশের বেশি উৎপাদিত হচ্ছে এই গ্রুপের কারখানায়। আসবাবশিল্পের এই কাঁচামালে আমদানিনির্ভরতা কমিয়েছে গ্রুপটি।
টেক্সটাইলে বিনিয়োগও হাতছাড়া করেনি টি কে গ্রুপ। ২০০৩ সালে সোয়েটার কারখানায় সরবরাহের জন্য অ্যাক্রিলিক সুতা তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করে গ্রুপটি। চীন হুং ফাইবার্স নামের এ কারখানায় প্রতিদিন ৬২ টন বিভিন্ন ধরনের সুতা উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশে এ ধরনের কারখানা এটিই প্রথম বলে জানায় গ্রুপটি।
১৯৯১ সালে টি কে কেমিক্যাল কমপ্লেক্স নামের কাগজের কারখানা গড়ে ওঠে টি কের হাতে। এ রকম অসংখ্য শিল্প খাতে পথ দেখিয়েছে গ্রুপটি। প্রথম কারখানা চালুর পর থেকে ২০০০ সালের আগপর্যন্ত গ্রুপটির হাতে ২৫টির মতো শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে, যেগুলো বাংলাদেশের শিল্পায়নে পথ দেখিয়েছে।
সিমেন্টে এ দেশে যাত্রা শুরু হয়েছে সরকারি খাতে। ১৯৯১ সালে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় চিটাগাং সিমেন্ট ক্লিংকার অ্যান্ড গ্রাইন্ডিং কারখানা। দরপত্রের মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে টি কের হাতে আসে কারখানাটি। বাংলাদেশে সিমেন্টশিল্পে ছাতকের পর দ্বিতীয় কারখানা ছিল সেটি, যেটি ১৯৭৩ সালে চালু হয়। কারখানাটি ২০০০ সালে হাইডেলবার্গ সিমেন্টের হাতে গেলেও বসে থাকেনি টি কে গ্রুপ। যৌথ অংশীদারত্বে প্রিমিয়ার সিমেন্ট কারখানায় বিনিয়োগ করেছে। নতুন বিনিয়োগের পর শীর্ষ পর্যায়ে উঠে এসেছিল কারখানাটির উৎপাদনক্ষমতা।
এসব শিল্পকারখানার বাইরেও শুরুর দিকে টি কের হাতে রড ও ঢেউটিন তৈরির কারখানার সূচনা হয়েছিল। যেমন টি কে রি-রোলিং মিলস নামের কারখানাটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৩ সালে। অবশ্য পরে রড কারখানায় থাকেনি গ্রুপটি। রডের পরিবর্তে ঢেউটিনে বিনিয়োগ করে তারা। ১৯৮৭ সালে ফৌজদারহাটে গড়ে তোলা হয় ঢেউটিন তৈরির কারখানা এনআর স্টিল গ্যালভানাইজিং। বর্তমানে গ্রুপের দুটি কারখানায় ঢেউটিন উৎপাদন হচ্ছে। ঈগল ব্র্যান্ডের নামে তা বাজারজাত করছে গ্রুপটি। সামুদা গ্রুপ সহ অন্যান্য টি.কে গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত।
বিনিয়োগে বৈচিত্র্য:-
এ দেশে শিল্পায়নের শুরুর দিকে দুই উদ্যোক্তা বিনিয়োগেও বৈচিত্র্য এনেছেন। অনেক খাতে পথও দেখিয়েছেন তাঁরা। ট্যানারিশিল্পের কথা ধরা যাক। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত রিফ লেদার কারখানাটি চামড়া প্রক্রিয়াকরণের প্রথম ধাপ ‘ওয়েট ব্লু’ ক্যাটাগরিতে প্রথম বৈশ্বিক মানসনদ অর্জন করেছে। দুই বছর আগে চামড়া খাতের বৈশ্বিক সংগঠন লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) এই মানসনদ দেয়। সব মিলিয়ে প্রথম ধাপে ওয়েট ব্লু, দ্বিতীয় ধাপে ক্রাস্ট ও তৃতীয় ধাপে ‘ফিনিশড’—তিনটিতেই মানসনদ পায় কোম্পানিটি। এর আগে দেশের দুটি কারখানা শেষ দুই ধাপে বৈশ্বিক মানসনদ পেলেও প্রথম ধাপ বা ‘ওয়েট ব্লু’ ক্যাটাগরিতে মানসনদ অর্জন করতে পারেনি। বৈশ্বিক মানসনদ অর্জনের কারণে বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডের কাছে চামড়া রপ্তানিতে পথে খুলে যায়। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে চামড়া রপ্তানি হচ্ছে রিফ লেদারের।
চা এখন এত জনপ্রিয় হবে, তা আড়াই দশক আগেও ভাবা যায়নি। সে সময় দেশি চায়ের উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি রপ্তানি হতো। এই খাতও চোখ এড়ায়নি টি কে গ্রুপের। ১৯৯০-এর দশকে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বারমাসিয়া চা-বাগান দিয়ে এই খাতে পথচলা শুরু হয় গ্রুপটির। এরপর যুক্ত হয় আরও দুটি বাগান। এই তিন বাগানে গত বছর ১৮ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়। পুষ্টি ব্র্যান্ড ও রাঙাপানি ব্ল্যাক টি নামে বাজারজাত হচ্ছে টি কের চা।
ভোজ্যতেল ছাড়াও আটা-ময়দার কারখানাও গড়ে তুলেছে গ্রুপটি। বিস্কুট খাতেও বিনিয়োগ করেছে গ্রুপটি।
ভোজ্যতেলে শীর্ষে:-
যে ভোজ্যতেল পরিশোধনের কারখানা দিয়ে শিল্পে হাতেখড়ি হয়েছে, সেই খাতে এখনো নিজেদের আধিপত্য ধরে রেখেছে টি কে গ্রুপ। সাড়ে তিন দশক ধরে গ্রুপটি এ খাতে সবচেয়ে বেশি নজর দিয়েছে। চাহিদা বাড়ার সঙ্গে যেমন আমদানি বাড়িয়েছে, তেমনি কারখানার সংখ্যাও বাড়িয়েছে। চট্টগ্রাম ছাড়াও ঢাকা ও খুলনায় মোট চারটি পরিশোধন কারখানা থেকে ভোজ্যতেল বাজারজাত করছে গ্রুপটি।
গত দুই দশকে ভোজ্যতেলের বাজারে শীর্ষে থেকেই অনেক প্রতিষ্ঠান ছিটকে পড়েছে। তবে বাজারের উত্থান-পতন সত্ত্বেও শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে টি কে। দেড় দশক আগের কথাই ধরি। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে দেশে যত ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে, তার ২১ শতাংশ করেছে টি কে। ওই বছর আমদানিতে শীর্ষে ছিল গ্রুপটি। এরপর কখনো দ্বিতীয় বা তৃতীয় অবস্থানে নেমে গেলেও ঠিকই বাজার অংশীদারিতে শীর্ষ স্থান পুনরুদ্ধার করেছে গ্রুপটি।
যেমন চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিতে শীর্ষ স্থানে রয়েছে গ্রুপটি। এ সময় ১৬ লাখ ৯৭ হাজার টন সয়াবিন ও পাম তেল বাজারজাত হয়েছে। এর এক-চতুর্থাংশই বাজারজাত করেছে টি কে গ্রুপ। এই তেল আমদানিতে গ্রুপটি আমদানি ব্যয় পরিশোধ করেছে ৫২ কোটি ৪৩ লাখ ডলার বা সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর শুরু হওয়া ভোজ্যতেলের সংকট ও অনিশ্চয়তার সময়েও আমদানি অব্যাহত রেখেছে গ্রুপটি।
শুধু পরিশোধনের কারখানা নয়, নারায়ণগঞ্জে সয়াবিন বীজ মাড়াই করে তেল ও প্রাণিখাদ্য উৎপাদনের কারখানায় বিনিয়োগ করেছে গ্রুপটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান। তাতে দিন শেষে বাজারে আধিপত্য থাকবে টি কে গ্রুপেরই।
দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতেও ঘুরছে শিল্পের চাকা
বাবা-চাচার দেখানো পথ ধরে দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতেও গড়ে উঠছে শিল্পকারখানা। টি কে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবুল কালামের সন্তান মোস্তফা হায়দার প্রচলিত খাতের বাইরে রাসায়নিক ও পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দেড় দশক আগে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে রাসায়নিক উৎপাদনের কারখানা ‘সামুদা কেমিক্যাল কমপ্লেক্স’ গড়ে তোলেন তিনি। বাংলাদেশে হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড ও কস্টিক সোডা খাতে পথ দেখানো কারখানাও এটি। এই কারখানা বাংলাদেশে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ ঘনত্বের হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড উৎপাদন শুরু করছে। টেক্সটাইলশিল্পে এই রাসায়নিকের ব্যবহার বেশি। উৎপাদন শুরুর পর হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড রাসায়নিক পণ্যটি আমদানি থেকে রপ্তানিনির্ভর পণ্যে পরিণত হয়। বাংলাদেশের চাহিদা মিটিয়ে এই কারখানার উৎপাদিত হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। এই কারখানার পর এখন দেশে অনেকেই এই খাতে যুক্ত হয়েছেন।
কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে ডাঙ্গারচরে জ্বালানি পণ্য উৎপাদনের বেসরকারি খাতের প্রথম কারখানা সুপার পেট্রোকেমিক্যালের মালিকানা আসে দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে। গ্যাসের উপজাত কনডেনসেট ও ন্যাপথা প্রক্রিয়াজাত করে এই কারখানায় অকটেন, ডিজেল, জাইলিনসহ জ্বালানির পাশাপাশি নানা ধরনের জ্বালানি পণ্য উৎপাদন হচ্ছে।
এই দুটি কারখানা ছাড়াও দেশের দুটি বড় অর্থনৈতিক অঞ্চলে বড় বিনিয়োগে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মোস্তফা হায়দার। যেমন বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে মডার্ন সিনটেক্স টেক্সটাইল গ্রেডের প্লাস্টিক চিপস তৈরির কারখানা গড়ে তুলছেন। এ প্রকল্পে বিনিয়োগ হচ্ছে ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়া সামুদা ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে রাসায়নিক দ্রব্য, ভোগ্যপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের কারখানায় প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। এতে প্রায় দুই হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এ ছাড়া মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ধলঘাটা) টি কে গ্রুপের অপর প্রতিষ্ঠান সুপার পেট্রোকেমিক্যাল ৪১০ একর ও সামুদা কেমিক্যাল কমপ্লেক্স ১০০ একর জমি নিয়েছে। সেখানে তারা কারখানা তৈরির কাজও শুরু করেছে।
টি কে গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবু তৈয়বের তিন সন্তান হাসনাত মোহাম্মদ আবু ওবায়দা, আবু সাদাত মোহাম্মদ ফয়সাল ও তালহা বিন তৈয়বের হাত ধরেও গড়ে উঠেছে নতুন নতুন শিল্পকারখানা। শতভাগ রপ্তানিমুখী ম্যাফ শুজ লিমিটেড ও ম্যাফ নিউজপ্রিন্ট কারখানা গড়ে তুলেছেন তাঁরা। বিনিয়োগ করেছেন কৃষি খাতেও। গড়ে তুলেছেন ম্যাফ ফার্মিং নামের প্রতিষ্ঠান। গত বছর ৬৫০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছে ম্যাফ শুজ। দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে গড়ে তোলা এসব কারখানা টি কে গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে।
টি কে এখন:-
টি কে গ্রুপের উদ্যোক্তা দুই ভাইয়ের একজন মোহাম্মদ আবু তৈয়ব ২০১৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সহধর্মিণী লায়লা বিলকিস বর্তমানে গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন অন্যতম উদ্যোক্তা মোহাম্মদ আবুল কালাম। দুই ভাইয়ের সন্তানেরা দ্বিতীয় প্রজন্ম হিসেবে পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
সাফল্যের নেপথ্যে:-
টি কে গ্রুপের অর্ধশত বছরের সাফল্যের নেপথ্যে আছে উদ্যোক্তাদের কঠোর পরিশ্রম ও সততা। ঋণখেলাপির এই যুগেও গ্রুপটির কোনো ব্যাংক চেক কখনো প্রত্যাখ্যাত হয়নি। আবার ব্যবসায়িক অঙ্গীকারও বরখেলাপ করেনি গ্রুপটি। গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবুল কালাম শুরু থেকেই এই দুটি বিষয়কে গ্রুপের মূলনীতি হিসেবে বাস্তবায়ন করেছেন। কারখানা গড়ে তোলার নেশায় নিজেও রাত-দিন কাটিয়েছেন কারখানায়। তাতে আজকের এই অবস্থানে এসেছে গ্রুপটি।
একটি উদাহরণ দিলেই হয়তো বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। ২০০৮ সালে বিদেশি সরবরাহকারীর সঙ্গে ১ হাজার ৪০০ ডলারে সয়াবিন তেল আমদানির চুক্তি হয়েছিল টি কে গ্রুপের। কয়েকটি চালানের চুক্তির পর সয়াবিন তেলের দাম অর্ধেক হয়ে যায়। সে সময় আমদানিকারক দেশগুলোর অনেকেই পিছুটান দিয়েছিল। তবে লোকসান হবে জেনেও ঋণপত্র খুলেছেন মোহাম্মদ আবুল কালাম। লোকসান দিয়ে অঙ্গীকার রক্ষা করেছেন।
টি কে গ্রুপের আজকের এ অবস্থানে উন্নীত হওয়ার জন্য সরকারের সহযোগিতা, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ ও ক্রেতার আস্থার কথা বললেন প্রধান উদ্যোক্তা ও গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবুল কালাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ক্রেতাদের কাছে সব সময় মানসম্মত পণ্য সরবরাহে গুরুত্ব দিয়েছে টি কে গ্রুপ। ক্রেতাদের কাছে আমাদের সব পণ্য ও সেবার গ্রহণযোগ্যতা নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। সরকারের সহযোগিতা পাওয়ায় নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে পেরেছি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও অবদান রাখতে টি কে গ্রুপ অবিরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’
যাঁরা উদ্যোক্তা হতে চান, তাঁদের প্রতি পরামর্শ জানতে চাইলে আবুল কালাম বলেন, উদ্যোক্তা হতে চাইলে সহজে হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। যে বিষয়ে উদ্যোক্তা হতে চান, সে বিষয়ে আগে থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে মাঠে নামতে হবে। সৎ ও পরিশ্রমের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করলে সফলতা আসবেই।
শুধু ব্যবসা নয়, গ্রুপটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সেবা খাতে নানাভাবে মানুষকে সহযোগিতা করে আসছে। পটিয়ায় টি কে গ্রুপের গড়ে তোলা একটি হাসপাতালে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে মানুষ। স্কুল, মেডিকেল কলেজসহ নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে গ্রুপটি। সততা ও নিষ্ঠার সহিত দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে দেশে বৃহৎ এ শিল্প গ্রুপটি।
সূত্রঃ প্রথম আলো (মে,)
![](https://bd-tjprotidin.com/wp-content/uploads/2021/10/7-300x42.gif)
![](https://bd-tjprotidin.com/wp-content/uploads/2024/02/IMG-20240220-WA0000-300x300.jpg)